শ্যামল মণ্ডলের কবিতা পড়ুন

দৃশ্যপিপাসু সমাজ << শ্যামল মণ্ডল

 দৃশ্যপিপাসু সমাজ


শ্যামল মণ্ডল



আমি বুঝে পাই না সমাজ আজ কোন দিকে ছুটছে। তবু কিছুটা আন্দাজ করা যায় বৈকি। যেন এক অদৃশ্য স্রোত সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনার দিকে—যেখানে চিন্তা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি সবই যেন একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজ ভাবতে চায় না, অনুভব করতে চায় না, সে কেবল দেখতে চায়।

হ্যাঁ, আমাদের সমাজ এখন এক দৃশ্যপিপাসু সমাজ—যেখানে চোখই সব কিছু, কান ও মন কেবল সহায়ক উপকরণ।

আগে মানুষ বলত—“চোখ দেখে না, মন দেখে।”

আজকাল মানুষ বলে—“চোখেই তো সব দেখা যায়!”

এই ‘দেখা’র আনন্দেই ডুবে আছে আধুনিক মানুষ।

একটি ছবি, একটি ভিডিও, একটি রিল—সবই এখন জীবনের পরিমাপক।

বই, ভাবনা, দর্শন—এই শব্দগুলো এখন যেন জাদুঘরের জিনিস।


ক) চোখের সমাজ


চোখ এক আশ্চর্য অঙ্গ—দেখে, মোহিত করে, আবার বিভ্রান্তও করে। কিন্তু সমাজ যখন পুরোপুরি চোখের দাসে পরিণত হয়, তখন সত্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।

আজ আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে চিত্রই সত্য, বাক্য নয়।

যে সুন্দর ছবি তুলতে পারে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি;

যে সুন্দরভাবে লিখতে পারে, তার কথা তেমন গুরুত্ব পায় না।

একজন মহিলা নিজের ছবি পোস্ট করলে সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্যের বন্যা—

“ওহ! কত সুন্দর!”, “একটু বেশি খোলা নয়?”, “এই বয়সে এ কেমন পোশাক?”

অথচ কেউ জিজ্ঞেস করে না—এই মুখের হাসির আড়ালে কোনো ক্লান্তি আছে কি না, কোনো ব্যথা আছে কি না।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম—সব জায়গায় একই দৃশ্য।

চিত্রের নীচে মানবতা ক্রমশ মুছে যাচ্ছে।

মানুষ এখন “দেখে” বেশি, “বোঝে” কম।

কারও লেখা পড়তে পাঁচ মিনিট সময় লাগে—অধিকাংশের তত ধৈর্য নেই।

এক মিনিটের ভিডিও-ই যথেষ্ট “বিনোদন।”

এইখানেই হারিয়ে যাচ্ছে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনের আসল আলো।


খ) সাহিত্য ও বিজ্ঞানের নির্বাসন


একসময় সাহিত্য ছিল সমাজের আয়না, বিজ্ঞান ছিল তার চিন্তার ডানাপ্রসার।

মানুষ বই পড়ত, গবেষণাপত্র পড়ত, বিতর্ক করত—

কী সত্য, কী ভালো, কী ন্যায়—এই নিয়ে ভাবত।

এখন মানুষ ভাবতে চায় না, কারণ ভাবা ক্লান্তিকর।

তার চেয়ে সহজ “স্ক্রল” করা।

চোখে চোখে পরিবর্তন আসে, কিন্তু মনের গভীরে অন্ধকার বাড়ে।

ফেসবুকে কোনো কবিতা দিলে, পাঁচজন পড়ে না।

কিন্তু কোনো ‘ফ্যাশন রিল’ বা ‘লিপ-সিঙ্ক’ দিলে হাজার লাইক।

তাহলে প্রশ্ন জাগে—মানুষের রুচি কি বদলে গেছে, না কি সে কেবল তার লুকানো ইচ্ছাগুলো প্রকাশ করছে?

সম্ভবত দুটোই সত্যি।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই গল্প।

চিন্তা বা গবেষণা এখন ‘কনটেন্ট’ হয়ে গেছে।

যা দ্রুত বোঝানো যায় না, সেটাই এখন অপ্রয়োজনীয় বলে গণ্য।

মানুষের সহিষ্ণুতা কমে গেছে, তাই দীর্ঘ চিন্তার জায়গা নেই।

সবকিছু হতে হবে দ্রুত, ছোট, চমকপ্রদ।


গ) নৈতিকতার পুনর্বিন্যাস


নৈতিকতার সংজ্ঞা একসময় অন্তরের বিষয় ছিল—

ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের মধ্যে ভারসাম্য।

এখন নৈতিকতা মাপা হয় দর্শকের সংখ্যায়।

যে বেশি দেখা যায়, সে-ই বেশি ‘গ্রহণযোগ্য।’

যে বেশি শেয়ার হয়, সে-ই ‘জনপ্রিয়।’

ফলে সমাজে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে—

‘কে কতটা দেখা যাবে?’

একসময় মানুষ কাজের মাধ্যমে পরিচিত হত, এখন চেহারার মাধ্যমে।

সাহিত্যিকের মুখ চিনে না কেউ, কিন্তু রিল-তারকার নাম সবাই জানে।

এই জনপ্রিয়তার নেশাই মানুষকে করে তুলছে ‘দৃশ্যপিপাসু।’

একটা সময় ছিল, যখন মানুষ চোখ বন্ধ করে ভাবত;

এখন সবাই চোখ খোলা রেখে অভিনয় করে।


ঘ) নারীর শরীর ও সমাজের চাহনি


সমাজের চোখ সবচেয়ে নির্মম নারীর প্রতি।

একজন পুরুষ ছবি দিলে কেউ কিছু বলে না,

একজন মহিলা ছবি দিলে তৎক্ষণাৎ সমাজের হাজার চোখ জেগে ওঠে।

কারও প্রশংসা, কারও নিন্দা, কারও গোপন আকাঙ্ক্ষা—সব মিলিয়ে এক ভয়ানক ভিড়।

এ সমাজ এখনো নারীর স্বাধীন দেহকে মেনে নিতে পারেনি।

তার ছবি মানে এখনো “আহা রে!” অথবা “উফ, কী সাহস!”

এই দুইয়ের মধ্যে নেই কোনো মানবতা, নেই কোনো সৌন্দর্যবোধ।

নারী এখনো শিল্প নয়, সে ‘দর্শনীয় বস্তু।’

এই মানসিকতা থেকে সাহিত্যও পালাতে পারছে না।

যেখানে নারীর চরিত্র লিখলেই পাঠক প্রথমে খোঁজে “কোথায় রোমাঞ্চ আছে।”

ফলে লেখকও বাধ্য হয় পাঠকের মন ভরাতে।

এভাবেই ধীরে ধীরে যৌনতা হয়ে উঠছে সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন মাপকাঠি।


ঙ) প্রযুক্তি ও প্রলোভন


প্রযুক্তি মানুষকে দিয়েছে অবিশ্বাস্য সুবিধা, কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ানক বিভ্রান্তিও।

এক ক্লিকেই এখন বিশ্ব দেখা যায়,

কিন্তু সেই বিশ্বের কোনো গভীরতা বোঝা যায় না।

সবকিছু তাত্ক্ষণিক, সবকিছু ঝলমলে।

এই তাড়াহুড়োর যুগে মানুষ ধৈর্য হারিয়েছে।

চিন্তা করার সময় নেই, ধীরে ভালোবাসার সময় নেই,

তাই সে চায় তাত্ক্ষণিক আনন্দ—দেখে, অনুভব না করে।

এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় “দৃশ্যপিপাসা।”

মানুষ এখন নিজের অস্তিত্বও প্রমাণ করতে চায় ছবির মাধ্যমে—

“আমি আছি”, “আমি খাচ্ছি”, “আমি ঘুরছি।”

এই ‘আমি’ যেন কেবল ক্যামেরার মধ্যে টিকে আছে।

বাস্তব মানুষ কোথায়, সেটা কেউ জানে না।


চ) মনুষ্যত্বের নিঃশব্দ ক্ষয়


যে সমাজ কেবল চোখে বাঁচে, সে ধীরে ধীরে মন হারিয়ে ফেলে।

সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, বিনয়—এই শব্দগুলো অচল হয়ে যাচ্ছে।

মানুষ এখন তুচ্ছ ঘটনায় হেসে ওঠে,

কিন্তু কারও কষ্টে আর চোখ ভিজে না।

আমাদের চোখ এখন অভ্যস্ত মৃত্যুর দৃশ্য দেখতেও,

যেন ওগুলোও এক প্রকার “কনটেন্ট।”

দুর্ঘটনার ভিডিও, মারধরের ছবি, রক্তাক্ত মুখ—

সবই এখন বিনোদনের উপাদান।

এমনকি মৃত্যুও এখন দৃশ্যপটের অংশ!

এইখানেই মানুষ নিজের মানবতা হারাচ্ছে।

একসময় মানুষ কান্না লুকিয়ে রাখত, এখন সেটাও শেয়ার করে।

যন্ত্রণা আর লজ্জা নেই, আছে কেবল প্রচার।


ছ) শিল্পের অপহরণ


শিল্প একসময় ছিল মননের মুক্তি।

আজ সেটাও বাজারের পণ্য।

চিত্রশিল্পী এখন ভাবেন না—‘আমি কী অনুভব করছি’,

তিনি ভাবেন—‘এটা কেমন দেখাবে ইনস্টাগ্রামে?’

কবিও তাই ভাবেন—‘এই লাইন ভাইরাল হবে তো?’

সৃজনশীলতার জায়গায় এসেছে প্রতিযোগিতা।

সত্যিকার শিল্পী হারিয়ে যাচ্ছেন, কারণ তিনি অভিনয় জানেন না।

তিনি ছবি তুলে নিজের মুখ বিক্রি করতে পারেন না।

তাই সমাজ তাঁকে ভুলে যাচ্ছে।


জ) চোখ থেকে মন—এক প্রত্যাবর্তনের আহ্বান

তবু সব শেষ হয়ে যায়নি।

এই দৃশ্যপিপাসার যুগেও কিছু মানুষ এখনো চোখের ওপারে তাকায়।

তারা এখনো শব্দে বিশ্বাস করে, অনুভূতিতে আশ্রয় খোঁজে।

তাদের লেখায় এখনো মানুষের গন্ধ আছে, মাটির স্পর্শ আছে।

সম্ভবত মানবসভ্যতা এমনই চক্রাকার—

কখনও উন্মত্ত দৃশ্যের দিকে ছুটে যায়,

আবার একদিন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে নীরব চিন্তায়।

আমাদেরও হয়তো সেই প্রত্যাবর্তন দরকার।

চোখের আনন্দ সীমিত, কিন্তু মনের শান্তি অসীম।

সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন—এই তিনই সেই শান্তির পথ দেখায়।

তাই আমাদের ফের ফিরে যেতে হবে দেখা থেকে বোঝার দিকে, বোঝা থেকে অনুভবের দিকে।


শেষ কথা

একটা সমাজের আসল মূল্য তার “দৃশ্য” নয়, তার “চিন্তা।”

যে সমাজ চিন্তা হারায়, সে সমাজ যতই ঝলমলে হোক, ভিতরে শূন্য হয়ে পড়ে।

আজ আমরা সেই শূন্যতার প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।

চোখে অগণিত রঙ, কিন্তু মনের ভিতরে নিস্তব্ধ ধূসরতা।


তবু আশার কথা আছে—

যতদিন একজন মানুষ প্রশ্ন করবে,

যতদিন কেউ বই খুলে ভাববে,

যতদিন কোনো কবি লিখবে ‘আমি বাঁচতে চাই ভাবনার মধ্যে’—

ততদিন এই দৃশ্যপিপাসা আমাদের পুরো গ্রাস করতে পারবে না।

আমরা একদিন আবার শিখব—

দেখা নয়, বোঝাই মানুষকে মানুষ করে।

আর বোঝার মধ্যেই আছে সভ্যতার আলো।


Previous
Next Post »