অ আ ক খ: বাংলা বর্ণমালার ইতিহাস, বিকাশ ও প্রভাব
-<< শ্যামল মণ্ডল
---
১. ভূমিকা
“অ আ ক খ”—এই চারটি বর্ণ যেন বাঙালির শিক্ষা ও চেতনার প্রথম ধাপ। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে এবং শিক্ষার প্রথম পাঠ নেয়, তখন তাকে শেখানো হয় “অ আ ক খ”। এই বর্ণগুলো শুধু ধ্বনি নয়, বরং বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের মৌল উপাদান। বাংলা ভাষার ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো এবং তার লিপি ও বর্ণমালা এসেছে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এই নিবন্ধে আমরা সন্ধান করব সেই বর্ণমালার উৎস, বিকাশ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ রূপান্তর নিয়ে।
---
২. ইন্দো-আর্য ভাষার শাখা ও বাংলা ভাষার উৎপত্তি
বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, যার মূল শাখা হলো ইন্দো-আর্য। এই শাখার অন্তর্গত প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে প্রাকৃত, পালি ও অপভ্রংশ ভাষা। এই অপভ্রংশ ভাষার একটি রূপ থেকেই উদ্ভব হয় প্রাচীন বাংলা।
বাংলা ভাষার সর্বপ্রথম লিখিত নিদর্শন হিসেবে ধরা হয় “চর্যাপদ” (৮ম–১২শ শতাব্দী)। এই ধর্মীয় গীতিগুলি ছিল সহজ ভাষায় রচিত এবং তার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রাথমিক রূপ বিদ্যমান। এখানে ব্যবহৃত ভাষাকে প্রাক-বাংলা বলা হয়, যেখানে সংস্কৃত ও প্রাকৃত শব্দের প্রভাব লক্ষণীয়।
---
৩. বাংলা লিপির বিবর্তন
বাংলা লিপির উৎপত্তি ব্রাহ্মী লিপি থেকে। প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মী লিপি থেকে জন্ম নেয় সিদ্ধমাত্রিকা, যা পরবর্তীতে গৌড়ীয় লিপিতে রূপান্তরিত হয়। এই গৌড়ীয় লিপিই ধীরে ধীরে বাংলা লিপিতে পরিণত হয়।
ব্রাহ্মী লিপি (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক): প্রাচীনতম লিখিত লিপি, যা অশোকের শিলালিপিতে ব্যবহৃত হয়।
সিদ্ধমাত্রিকা (৬ষ্ঠ–৯ম শতক): ব্রাহ্মীর উত্তরসূরি, যার মধ্যে ধ্বনির সুসংগঠিত চিহ্ন লক্ষ করা যায়।
গৌড়ীয় লিপি (৯ম–১৩শ শতক): বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া ইত্যাদি লিপির উৎস।
এইসব লিপি ব্যবহার করে গঠিত হয় বাংলা লিপি, যা ১৩শ শতকের পর থেকে পরিচিত রূপ পেতে শুরু করে। মুসলিম শাসনামলে বাংলা লিপি আরও পরিবর্তিত হয় এবং মুঘল আমলে এটি দাপ্তরিক ও সাহিত্যে আরও বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
---
৪. বর্ণমালার গঠন ও ধ্বনিবিজ্ঞান
বাংলা বর্ণমালার গঠন মূলত সংস্কৃত ভাষার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। বর্ণমালাটি দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত:
স্বরবর্ণ (১১টি): অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ
ব্যঞ্জনবর্ণ (৩৯টি): ক-ক্ষ, চ-ঞ, ট-ণ, ত-ন, প-ম, য-হ, শ-ষ-স, হ, ড়-ঢ়, য়
এছাড়া রয়েছে কিছু চিহ্ন: চন্দ্রবিন্দু (ঁ), অনুস্বার (ং), বিসর্গ (ঃ)।
এই বর্ণগুলি ধ্বনিগতভাবে শ্রুতিগত পার্থক্যের ভিত্তিতে বিন্যস্ত। স্বরধ্বনির উচ্চারণ স্থান ও পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে প্রথম স্বরবর্ণ, তারপর ব্যঞ্জনবর্ণ দেওয়া হয়। সংস্কৃত ভাষার বিন্যাস পদ্ধতি অনুসরণ করায় বাংলা বর্ণমালার কাঠামো সুসংবদ্ধ।
---
৫. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ এবং আধুনিক বর্ণ শিক্ষা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–১৮৯১) বাংলা বর্ণ শিক্ষায় বিপ্লব এনেছেন। ১৮৫৫ সালে তিনি রচনা করেন ‘বর্ণপরিচয়’ — বাংলা ভাষায় বর্ণ শেখার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক বই।
তিনি শিশুদের উপযোগী করে “অ আ ক খ” ধারায় বর্ণ উপস্থাপন করেন, যেখানে প্রতিটি বর্ণের সঙ্গে একটি করে শব্দ বা বাক্য যুক্ত ছিল, যেমন:
অ – অজগর আসছে তেড়ে
আ – আমটি খুব মিষ্টি
ক – কাক ডাকে কা কা
এই ছন্দযুক্ত, সহজ এবং প্রাসঙ্গিক উদাহরণগুলো শিশুদের জন্য শেখাকে আনন্দময় করে তোলে। বর্ণপরিচয়-এর মাধ্যমে বাংলা বর্ণমালার একটি সাংগঠনিক ধারা তৈরি হয় যা আজও চালু রয়েছে।
---
৬. শিশু মনস্তত্ত্ব ও বর্ণ শেখার পদ্ধতি
শিশুরা যখন শেখে, তখন তারা ধ্বনি, ছবি এবং ছন্দময়তার প্রতি সংবেদনশীল থাকে। এই কারণে ‘অ আ ক খ’ শেখানো হয় গল্প, ছড়া, চিত্র এবং গান ব্যবহার করে। মন্টেসরি পদ্ধতি অনুযায়ী শেখার ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়-ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি জোরালো ভূমিকা রাখে।
বর্ণ শেখার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
চিত্র সহ বর্ণ পরিচয়
শব্দ গঠন খেলা
ছড়ার মাধ্যমে শেখা
বর্ণের আকৃতি আঁকা
স্মার্ট অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহার
---
৭. “অ আ ক খ” এর সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ব্যবহার
বাংলা সাহিত্যে এবং লোকসংস্কৃতিতে “অ আ ক খ” শুধুমাত্র শিক্ষার অংশ নয়, এটি একপ্রকার প্রতীক।
কবিতা ও ছড়ায়:
“অ আ ক খ শেখো ছোটরা, বই হাতে নাও।”
সুকুমার রায়ের ছড়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু কবিতা
গানে ও নাটকে:
নজরুল ইসলামের শিশু সংগীত
শিশু একাডেমির সঙ্গীতচিত্র
সমসাময়িক সাহিত্যেও:
শরৎচন্দ্রের গল্পে, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসে বর্ণ স্মৃতি
---
৮. প্রযুক্তি যুগে বাংলা বর্ণ শিক্ষা
বর্তমান যুগে শিশুদের শেখার ধরণ বদলে গেছে। বই ও স্লেটের জায়গায় এসেছে মোবাইল অ্যাপ, ইন্টারঅ্যাকটিভ ভিডিও এবং গেম-ভিত্তিক শিক্ষা।
বর্ণ শেখায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি:
“Learn Bengali Alphabets” মোবাইল অ্যাপ
ইউটিউব চ্যানেলে অ্যানিমেশন ভিডিও
ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিজিটাল বই
বাংলাদেশ সরকার ICT in Education পলিসি অনুযায়ী বাংলা ভাষা শিক্ষাকে ডিজিটাল মাধ্যমে পৌঁছে দিতে কাজ করছে। ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষে ‘অ আ ক খ’ শেখানো হচ্ছে স্মার্ট বোর্ডে।
---
৯. বাংলা বর্ণমালার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব
বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা এবং ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ এটি ব্যবহার করে। ইউনিকোড বাংলা ফন্ট সিস্টেম চালু হবার পর বাংলা লেখাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
বাংলা ভাষার বৈশ্বিক উপস্থিতি:
প্রবাসী বাংলাদেশি ও বাঙালি সম্প্রদায়
বাংলা শেখার অনলাইন কোর্স (Coursera, Duolingo)
জাতিসংঘে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি
---
১০. ভবিষ্যতের বাংলা বর্ণমালা শিক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
চ্যালেঞ্জ:
ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন
মিশ্র ভাষা ব্যবহার (বাংলিশ)
প্রবাসী শিশুদের বাংলা শেখার অনীহা
সম্ভাবনা:
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) ভিত্তিক ভাষা শিক্ষা
AI ও গেমিং ব্যবহার করে ইন্টারঅ্যাকটিভ শিক্ষা
বাংলা ভাষায় শিশুদের কমিক, গান, অ্যানিমে
---
উপসংহার
“অ আ ক খ”—এই চারটি বর্ণের মধ্যে নিহিত আছে একটি জাতির শিক্ষা, ইতিহাস, আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতি। বাংলা ভাষার বর্ণমালা শুধু লেখার মাধ্যম নয়, বরং বাঙালির আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সাংস্কৃতিক নিদর্শন। ইতিহাসের ধারায় এই বর্ণগুলো বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের রূপ পেয়েছে। কিন্তু সময় যতই যাক না কেন, “অ আ ক খ” রয়ে যাবে বাঙালির প্রথম চেনা সুর, চিরন্তন শিক্ষা ও ভালোবাসার এক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে।