মন-ভিখারী
কলমে: শ্যামল মণ্ডল
সেদিন দুপুরবেলা, কলেজ থেকে ফিরে আর কাজল থামতেই পারল না। চোখের সামনে ভাসছে একটা অদ্ভুত দৃশ্য। কলেজ গেটের কাছে রোদে পুড়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ—মাথায় ধূসর চুল, পরনে ময়লা ধুতি আর একটা শীতের কোট, যার বোতামগুলো নেই, কিন্তু তবু গায়ে চাপানো। পাশে একটা ছোট্ট থলি, তাতে অল্প কিছু শুকনো মুড়ি। তিনি কাউকে টাকা চান না, খাবারও না। শুধু একটা কথা বলছেন—“মন দেবে গো, মন?”
সেই এক কথা, প্রতিটি পথচারীর সামনে হাত জোড় করে বলছেন—
“ভাইরে, একটুখানি মন দাও।”
কেউ থেমে তাকাচ্ছে, কেউ ঠাট্টা করছে, কেউবা বলছে—“পাগল কোথাকার!”
কিন্তু কাজলের মনে হল, এই লোকটা ভিন্ন। তার চাহনিতে ছিল অপার শূন্যতা, যেন শত শত বছর ধরে ভালোবাসাহীনতার বোঝা বয়ে নিয়ে এসেছেন তিনি।
কাজলের মা, রত্না দেবী, বেসরকারি স্কুলে পড়ান। মেয়ের এই প্রশ্নে হেসে বললেন,
— “সে তো পাগল। শহরে কতরকম মানুষ ঘুরে বেড়ায়।”
কিন্তু কাজলের মন মানল না। পরদিন একটা লাল কাগজে সে একটি হৃদয় আকৃতি এঁকে লিখল—
“আমার একটা মন তোমার জন্য”
কলেজে গিয়ে বৃদ্ধকে খুঁজল সে। তিনি বসে আছেন আগের জায়গাতেই। আজও বলছেন—
“মন দেবে গো মন?”
কাজল এগিয়ে গেল।
— “আমি একটা মন এনেছি,” বলেই কাগজটা তার হাতে দিল।
বৃদ্ধ থমকে গেলেন। কাগজটা হাতে নিয়ে এমনভাবে চেয়ে রইলেন, যেন এক বিশ্বদরিদ্র ব্যক্তি হঠাৎ সোনা পেয়েছে। চোখ দুটি চিকচিক করছে।
— “তুই মন দিলি মা?”
— “হ্যাঁ।”
— “তাহলে আমি আর গরীব নই... আমি ধনী...”
তিন সপ্তাহ কেটে গেল। শহরের মানুষ বুঝতে লাগল, এই ‘পাগল’ লোকটি হয়তো সত্যিই কিছু বোঝাতে চাইছেন। কেউ তাকে এক কাপ চা দেয়, কেউ তাকে নিজের ক্লান্তির কথা বলে। আশেপাশের কুকুর-বিড়ালও যেন তার আশপাশে ভিড় করতে শুরু করেছে।
কেউ তাকে ডাকত “মন-দাদা”, কেউ বলত “ভালোবাসার সাধু”।
তবে একটা বিষয়ে সবাই অবাক হত—কেশব দার (যে নামটা পরবর্তীতে তিনি বলেছিলেন) কখনো কিছু রাখতেন না নিজের জন্য। মানুষ যা দিতেন, তিনি ভাগ করে দিতেন পাশের রিকশাচালক, ফুলওয়ালি, কিংবা কুকুরের সঙ্গে।
কাজল মাঝে মাঝে বসে শুনত তাঁর গল্প।
— “আমার একসময় পরিবার ছিল মা... স্ত্রী, সন্তান, বন্ধুবান্ধব... কিন্তু সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের জীবনে। মন দেওয়া বন্ধ করল। আমি চাইনি কিছু, শুধু একটু হৃদয়... একটু সঙ্গ। কেউ দিল না।”
— “তাই তুমি চলে এলে?”
— “না, আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আবার খুঁজে পেয়েছি কিছু কিছু... যেমন তুই।”
কেশবদার গল্প ছড়িয়ে পড়ল শহরে। সাংবাদিক এলেন সাক্ষাৎকার নিতে। একটা স্থানীয় চ্যানেলে প্রচার হল তাঁর কথা। শিরোনাম ছিল: "এক ভিখারী যে চায় শুধু মন!"
লোকজনের দৃষ্টি বদলাতে লাগল। যে শহর আগে কেবল ব্যস্ততায় ভরপুর ছিল, সেখানে একটা ছোট্ট স্থানে তৈরি হল "মন-আড্ডা"। মানুষ এখানে আসে শুধুই কথা বলার জন্য, শুনতে ও শুনানোর জন্য। কেউ কফি নিয়ে আসে, কেউ গিটার বাজায়, কেউ গান গায়।
কেশবদার পাশে বসে থাকা এক বৃদ্ধ বলেন একদিন,
— “এই মানুষটা আমার মেয়ের মতোই কথা শোনে। গত দশ বছর পর আমার কেউ মন দিয়ে শুনল!”
এক তরুণী চাকরির হতাশা নিয়ে এসে কাঁদে, কেশবদা বলে—
— “তোর কষ্ট শুনে আমার মন ভরে গেল মা। এবার তুই হাল ছাড়িস না।”
এই ছোট্ট জায়গাটা হয়ে উঠল শহরের হৃদয়।
হঠাৎ একদিন কেশবদা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শহরের মানুষ তৎপর হল। তাঁকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হল। কাজল, তার মা, আর কিছু বন্ধুরা দিনরাত সেবা করল।
শেষের দিনটা এসে গেল এক বর্ষার রাতে।
কাজল পাশে বসে আছে। কেশবদা ধীরে ধীরে বলছেন,
— “তুই জানিস কাজল... আমি গরীব ছিলাম না, শুধু ভুলে গিয়েছিলাম কীভাবে চাইতে হয়। মানুষ যখন হৃদয় চায়, তখন সে আসলে ঈশ্বর চায়। আর আমি ঈশ্বরকে তোমাদের মধ্যে পেয়েছি।”
সেদিন গভীর রাতে কেশবদার মৃত্যু হয়। কোনো আত্মীয় ছিল না, কিন্তু শেষকৃত্যে শত শত মানুষ হাজির হয়।
কাজল এবং অন্যরা মিলে কলেজ গেটের পাশে একটা ছোট ফলক বসায়—
“এখানে এক মন-ভিখারী থাকতেন। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, হৃদয়ই মানবতার শেষ আশ্রয়।”
আজ বছর পাঁচেক হয়ে গেছে। সেই জায়গাটির নাম এখন শহরের মানচিত্রে রয়েছে—"মন চত্বর"। প্রতিদিন সেখানে কিছু মানুষ আসে শুধু কথা বলতে, হৃদয় ভাগ করে নিতে।
একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা জানে, মোবাইলের স্ক্রল নয়, মানুষের মনই আসল সান্নিধ্য।
আর কাজল? সে এখন মনোবিদ। তার চেম্বারের দরজার বাইরে ঝুলছে একটা কোটেশন—
“মানুষ শুধু শ্বাসে বাঁচে না, ভালোবাসাতেও বাঁচে।”
