অন্ধকারের শ্বাস
(একটি বৈজ্ঞানিক কল্পগল্প)
শ্যামল মণ্ডল
১. ধ্বংস ও জন্ম
বছর ২১৪৭।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত। ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত। সূর্যরশ্মির অধিকাংশ পৃথিবীতে পৌঁছায় না। গাছপালা বিলুপ্ত। পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণী মারা গেছে বা বিলুপ্তপ্রায়। মানুষ ভূগর্ভস্থ এবং সমুদ্রতলের কৃত্রিম কোলনিতে বসবাস করছে। প্রাকৃতিক অক্সিজেনের চিহ্নমাত্র নেই। কৃত্রিম অক্সিজেন প্লান্টগুলো ভেঙে পড়ছে একে একে।
এই সর্বনাশের মধ্যে একটাই আশার আলো—ডার্ক অক্সিজেন।
প্রশান্ত মহাসাগরের এক বিস্মৃত অঞ্চল—Clarion-Clipperton Zone (CCZ)—সেখানেই সন্ধান মিলেছে এক অভাবনীয় প্রাণরহস্যের। সূর্যালোকহীন, চির অন্ধকার জলে জন্ম নিচ্ছে অক্সিজেন! না কোনো গাছ, না কোনো অ্যালগি—তবু প্রাণের নিঃশ্বাস সেখানে।
এই রহস্য উদঘাটনের জন্য গঠিত হয় মিশন ডিপ ব্লুম-৯।
২. মিশন শুরু
অভিযাত্রী দল:
ক্যাপ্টেন তাবাসসুম আনোয়ার – মিশন কমান্ডার, প্রাক্তন নভোচারী
ড. অনিরুদ্ধ রায় – সিনিয়র বায়োজিনেটিক্স বিশেষজ্ঞ
ড. এলিনা শর্মা – মাইক্রোবায়োলজিস্ট
সায়মন চৌধুরী – সাবমেরিন ও লাইফ সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার
মেহর – একটি হিউম্যানয়েড রোবট, AI চালিত, তথ্য বিশ্লেষণে দক্ষ
তারা নামে সমুদ্রের ৪০০০ মিটার গভীরে, সাবমেরিন "অর্চিডিয়া"-তে করে।
ঘন অন্ধকার, চাপ এত বেশি যে চোখে কিছুই দেখা যায় না, একমাত্র হাইড্রোসোনিক রাডারেই ধরা পড়ে আশেপাশের ছবি। হঠাৎই রাডারে উঠে এল এক অঞ্চল—জলে অক্সিজেনের মাত্রা অস্বাভাবিক রকম বেশি। এবং সেখানে কোনো সুর্যালোক নেই!
"এটা অবিশ্বাস্য," বললেন অনিরুদ্ধ। "জীবন এখানে কীভাবে টিকে আছে?"
"জীবন নয়, অনিরুদ্ধ," মেহর বলে, "এটা সম্পূর্ণ নতুন রকমের বেঁচে থাকা।"
৩. প্রথম শ্বাস
তারা মাটির তলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। দেখতে কালচে নীল রঙের একধরনের এককোষী অণুজীব, কোনো পরিচিত শ্রেণির সঙ্গে মিল নেই। তার শরীরে এক ধরনের ন্যানোস্কেল চেম্বার, যার ভেতর বৈদ্যুতিক প্রবাহ হয়।
ড. এলিনা বলেন, "এরা নিজেরাই বিদ্যুৎ তৈরি করে জল বিশ্লিষ্ট করছে—O₂ বেরোচ্ছে! কোনো আলোর দরকার নেই!"
"তাহলে এগুলো কি অজানা রকমের ফটোসিন্থেসিস করছে?"
"না, একে বলা যায় ইলেক্ট্রোসিন্থেসিস।"
তারা এই নমুনা নিয়ে ফিরে আসে গবেষণা কেন্দ্রে। শুরু হয় বিশ্লেষণ।
৪. ব্যতিক্রম
গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ব্যাকটেরিয়াগুলোর মিউটেশন ক্ষমতা অসাধারণ। প্রতিটি বৈষম্য কিংবা চাপের প্রতিক্রিয়ায় তারা বদলে ফেলে নিজেদের গঠন। অক্সিজেন তৈরির হার ক্রমশ বাড়ে।
গবেষণাগারে ডার্ক অক্সিজেন রিঅ্যাক্টর বানানো হয়। সেখানে কৃত্রিমভাবে ওই ব্যাকটেরিয়া প্রতিস্থাপন করে পরীক্ষা চালানো হয়। অক্সিজেন তৈরি হয়, চাপ তৈরি হয়, রিঅ্যাক্টরের গ্লাস ফেটে যায়।
"এরা কেবল বেঁচে নেই," অনিরুদ্ধ বলেন, "এরা লড়ছে। আমাদের জন্যও নয়, নিজেদের জন্য।"
৫. ছায়া ঘনিয়ে আসে
একদিন হঠাৎ রিঅ্যাক্টর ২-এ বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। এলিনা কেমিক্যাল পরীক্ষা করে দেখেন—ব্যাকটেরিয়ারা অতিরিক্ত চাপের কারণে অ্যানারোবিক টক্সিন তৈরি করছে।
"আমরা যদি সীমা না মানি, ওরাও মারাত্মক হয়ে উঠবে," সে বলে।
এদিকে মেহর এক ফাইল খুঁজে পায়—২০৩৭ সালে NASA-এর গোপন এক গবেষণায় একই রকম ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হয়েছিল মঙ্গলগ্রহের মাটিতে। কিন্তু সেই গবেষণার ফাইল চেপে রাখা হয়েছিল।
"এর মানে..." ক্যাপ্টেন ধীরে বলেন, "এই জীবের উৎস কি শুধু পৃথিবী নয়?"
৬. বিস্ফোরণ ও প্রত্যাবর্তন
একদিন গভীর রাতে মিশনের রিঅ্যাক্টর রুমে বিস্ফোরণ ঘটে। অনিরুদ্ধ ও সায়মন আহত হন। রিঅ্যাক্টরের চাপ সামলাতে না পেরে ব্যাকটেরিয়াগুলো মুক্ত হয়ে পড়ে আশপাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে কেন্দ্রজুড়ে বাতাস ভারী হয়ে আসে—অক্সিজেনের মাত্রা হঠাৎ ২৭% ছাড়িয়ে যায়।
তাবাসসুম জরুরি সভা ডাকেন।
"আমরা এই মুহূর্তে এক জীবন্ত অস্ত্রের সঙ্গে বসবাস করছি। আমরা যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি, পৃথিবী বাঁচবে না, পুড়ে যাবে।"
তবু এলিনা একমনে বলে, "কিন্তু আমরা বাঁচতেও পারি। প্রথমবারের মতো, আমরা আবার শ্বাস নিতে পারি।"
৭. সিদ্ধান্ত
অবশেষে ডিপ ব্লুম দল ঠিক করে—নতুন সংস্করণের রিঅ্যাক্টর বানাবে, যেখানে ব্যাকটেরিয়া নিজে নিজেই চক্র নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। AI এবং ব্যাকটেরিয়ার যৌথ নিয়ন্ত্রণে হবে এই অক্সিজেন উৎপাদন।
৩ মাস পরে, মিশন সফলভাবে 'ডার্ক অক্সিজেন সিস্টেম' পাঠায় পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ শহরগুলোতে।
ধীরে ধীরে কৃত্রিম অক্সিজেন প্লান্টের পরিবর্তে আসে এই নতুন প্রাকৃতিকতর পদ্ধতি।
মানুষ আবার শ্বাস নেয়।
আবার বাঁচে।
৮. শেষ বর্ণনা
অনিরুদ্ধ এক দিনলিপি লেখেন:
“শ্বাস মানে কেবল বেঁচে থাকা নয়।
শ্বাস মানে বিশ্বাস—যে অন্ধকারেও আলো আছে।
আমরা ডার্ক অক্সিজেন আবিষ্কার করিনি।
সে নিজেই আমাদের খুঁজে নিয়েছে।”
অন্ধকারের শ্বাস: ডার্ক অক্সিজেন ও ভবিষ্যতের প্রাণরহস্য
— শ্যামল মণ্ডল
(এক বৈজ্ঞানিক কল্পগল্পের অন্তরালে আসল বিজ্ঞান ও কল্পনার মেলবন্ধন)
ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বাতাস নেই। অক্সিজেন নিঃশেষ। কিন্তু সমুদ্রের অতল অন্ধকারে, সূর্যের আলো যেখানে পৌঁছায় না, সেখানে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন প্রাণশক্তি—‘ডার্ক অক্সিজেন’।
এই কল্পগল্পে লেখক শ্যামল মণ্ডল তুলে ধরেছেন এক বৈজ্ঞানিক আশ্চর্যতার চিত্র, যেখানে প্রযুক্তি ও প্রাণ বিজ্ঞান মিলে গড়ে তুলেছে নতুন সভ্যতার সম্ভাবনা। 'ডিপ ব্লুম-৯' মিশন, অণুজীবের বৈদ্যুতিক শ্বাসপ্রক্রিয়া, এবং মানুষের শেষ আশার লড়াই—সব মিলে এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের গল্প।
--
গল্পের মূলসূত্র:
সময়কাল: ২১৪৭ সাল
স্থান: প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর অঞ্চল (Clarion-Clipperton Zone)
মূল চরিত্র:
ক্যাপ্টেন তাবাসসুম (মিশন লিডার)
ড. অনিরুদ্ধ (জিন বিজ্ঞানী)
ড. এলিনা (মাইক্রোবায়োলজিস্ট)
AI রোবট মেহর
মূল সমস্যা: পৃথিবীর অক্সিজেন ফুরিয়ে আসা
মূল আবিষ্কার: আলোহীন অণুজীব দ্বারা অক্সিজেন তৈরি—‘ডার্ক অক্সিজেন’
--
ডার্ক অক্সিজেন: শুধু গল্প নয়, বাস্তবের সম্ভাবনা
গল্পটি একটি বাস্তব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অনুপ্রেরণায় লেখা—২০২৩ সালে Nature Geoscience–এ প্রকাশিত হয় এমন এক গবেষণা, যেখানে হাওয়াই-মেক্সিকো সীমানার সিসিজেড অঞ্চলে আলোবিহীন সমুদ্রতলে অক্সিজেন তৈরি হতে দেখা যায়। লেখক সেই তথ্যকে গল্পের কাঠামোয় এনে মানুষের ভবিষ্যৎ বেঁচে থাকার এক নতুন দিগন্ত রচনা করেছেন।
---
১) পাঠকের জন্য ভাবনার খোরাক:
১) কীভাবে প্রযুক্তি প্রকৃতির বিকল্প হতে পারে?
২) ‘জীবন’ আর ‘জীবনধারণ’-এর পার্থক্য কোথায়?
৩) অন্ধকার মানেই কি শূন্যতা, না কি সম্ভাবনার জন্মভূমি?